
বিচার নিয়ে আমাদের আন্তরিকতায় সন্দেহ রাখবেন না -আইন উপদেষ্টা
- আপলোড সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ০৩:৫১:৩২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ০৩:৫১:৩২ অপরাহ্ন


জুলাই আন্দোলনে গণহত্যার বিচার নিয়ে সরকারের আন্তরিকতায় বিন্দু মাত্র সন্দেহ না রাখার আহ্বান জানিয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, আমাদের (সরকার) অনেক ব্যর্থতা আছে, কিন্তু চেষ্টায় ব্যর্থতা নেই। চেষ্টার ক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্য নেই। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। জুলাই গণহত্যার বিচার আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে আসিফ নজরুল বলেন, অনেক অভিযোগ শুনি, অনেক কিছু শুনি, খুব দুঃখ লাগে মাঝে মাঝে। তারপর মনে হয় যে, এটার জন্যই তো আমাদের সন্তানরা প্রাণ দিয়েছিল, যে আপনারা আমাদের প্রশ্ন করবেন, সমালোচনা করবেন। কষ্ট লাগলেও শুনব, আবার নিজেও কাজ করব। কিন্তু আপনাদের একটা জিনিস বলতে চাই, আমি যেন আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতাটা করতে পারি। তিনি বলেন, আল্লাহ তো আমাকে দেখছেন। আমি কি আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারব? আপনাদের কনফিডেন্টলি বলে যেতে চাই, অবশ্যই পারব। কোনো রকম গাফিলতি কোনো জায়গায় করিনি, কোনো রকম অন্যায় কোনো জায়গায় করিনি। জীবনে কোনোদিন এত পরিশ্রম করিনি। আর যাই করুন, এই বিচার নিয়ে আমাদের আন্তরিকতায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ রাখবেন না। মানুষ তো তুচ্ছ ব্যাপার, আল্লাহর কাছে জবাব দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত আছি। তিনি আরও বলেন, আমি যদি শহীদের পিতা হতাম, আমারও প্রশ্ন থাকত। আপনাদের মতো সন্তান হারালে আমি আরও বেশি ইমোশনাল হয়ে যেতাম, আরও বেশি অ্যাগ্রেসিভলি সমালোচনা করতাম। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। কিন্তু যদি সমাজের অন্যান্য মহল থেকে এসে বলে বিচার দৃশ্যমান হচ্ছে না, আর কীভাবে দৃশ্যমান হয়? টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। প্রথম দিন থেকে টিভি দেখাচ্ছে আমাদের। প্রতিদিন তাজুল ইসলাম (চিফ প্রসিকিউটর) আপডেট দিচ্ছেন। কী করব ভাই? এই ১০ মাস যাবত লাইভ দেখাব? তাজুল রাত ২টার সময় কী কাজ করেন, সেটি দেখবেন? সেটা কি আমরা লাইভ দেখাব? আইন উপদেষ্টা বলেন, শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছেন, আমার মনে হয় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীও এত জঘন্য অপরাধ করেনি। মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা, আহত মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা। আপনারা বলতে পারেন, ২৫ মার্চ কালো রাত হয়েছে। অবশ্যই ২৫ মার্চ কালো রাতে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অন্যদেশের বাহিনী করেছে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে এমন কোনো ফুটেজ আমি দেখিনি। একজন গুলি খেয়েছে, তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার বন্ধু, সেই অবস্থায় গুলি করেছে, এমন কোনো ফুটেজ বা কোনো বর্ণনা আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধার মুখে শুনিনি। অন্যরকম নৃশংসতা থাকতে পারে, কিন্তু এমন নৃশংসতা কখনো শুনিনি। এত বড় গণহত্যা চালিয়েও আওয়ামী লীগের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, একটা দল ১৫ বছর শুধু মিথ্যা আর নির্যাতন করে চালিয়েছে। এখনো তাদের মিথ্যাচার বিন্দুমাত্র থামেনি। এখনো নির্যাতনের ইচ্ছা বিন্দুমাত্র থামেনি। আপনারা যখন মহাখুনি শেখ হাসিনার অডিওগুলো শুনতে পান, দেখবেন এখনো তার নির্যাতন করার ইচ্ছা আছে। এরা কি বিচারে কোনো রকম গাফিলতি থাকে সেটা উন্মোচন করার চেষ্টা করবে না? আমার তো অনেক দায়িত্ব। এই বিচারকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, এই বিচারে আপনাদের (শহীদ পরিবার) হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করি, যেই প্রক্রিয়ায় বিচার এগোচ্ছে, ইনশাআল্লাহ আমাদের সরকারের আমলেই আপনারা কাঙ্ক্ষিত মামলাগুলোর রায় পাবেন। এমনভাবে বিচারের অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ আমরা রেখে যাব, কোনো সরকার চাইলেও বিচার থেকে সরতে পারবে না। জুলাই গণহত্যার আনুষ্ঠানিক বিচার অবশ্যই হবে জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আনুষ্ঠানিক বিচারের পাশাপাশি রাষ্ট্রটাকে যদি আমরা ঢেলে সাজাতে চাই, সেজন্য আমাদের প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। আর সেই পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ সরে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পাবে। অনুষ্ঠানে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, অপরাধের বিচার না হলে দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের কোনো ধরনের আস্থা থাকবে না। সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করছে। বিচারিক একটি পদ্ধতি আছে, সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে সেই পদ্ধতি মেনেই বিচার করা হচ্ছে-যাতে করে এই বিচার নিয়ে কখনও কোনো নেতিবাচক কথা উঠতে না পারে। তিনি আরও বলেন, আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করতাম, যে দেশে একটি মানুষ বেঁচে আছে, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে যারা দেশ চালায়, তারা তাকে মেরে ফেলতে চায়। তারা নাগরিকদের পুড়িয়ে ফেলতে চায়। দেশের সরকারের হাতে নাগরিকেরা কী পরিমাণ অনিরাপদ হয়ে যায় শুধুমাত্র ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের কারণে-সেটা আমাদের ওই মৃত্যু থেকে উপলব্ধি করতে হবে। পরিবেশ উপদেষ্টা আরও বলেন, যদি দেশকে আমরা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে না ধরতে পারি, তাহলে বিচার কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন হয়েই থাকবে। এই অন্যায়গুলো বারবার পুনরাবৃত্ত হতে পারে। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক বিচারের পাশাপাশি দেশ বদলানোর যে দায়িত্ব, বাসনা ও ইচ্ছা মানুষের মধ্যে আছে, সেটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। যে দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, দলীয় সরকারের মুখপাত্র হয়ে যায় এবং সেটা চরম আকারে পৌঁছে যায়-তখনই এমন ঘটনা ঘটে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যারা নির্দেশদাতা, তারা প্রায় সকলেই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তারা কীভাবে পালাতে পারলো? আপনি তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করবেন, কিন্তু তাদের উপস্থিত রাখতে পারলেন না-এখান থেকেই বোঝা যায় রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু স্থানে বিচারহীনতা বিরাজ করছে। তিনি আরও বলেন, আমরা আর কোনো কসমেটিক পরিবর্তন দেখতে চাই না। সত্যিকারের অর্থে মূল্যবোধের জায়গা থেকে পরিবর্তন দেখতে চাই। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে-যারা এই খুনগুলো করেছে, তাদের সমর্থকেরা এখনো সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে। না থাকলে তারা কীভাবে পালিয়ে গেল? এটা আমাদের বুঝতে হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহেরের স্বাগত বক্তব্যের পর জুলাই আন্দোলনে নিহত এবং সম্প্রতি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। পরে তাদের স্মরণে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব (বাজেট ও উন্নয়ন) রুহুল আমীন। এরপর জুলাই আন্দোলন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, জুলাই আন্দোলনে শহীদ ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন, শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ছাত্র প্রতিনিধি আরমান হোসেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ